৫৪ ধারায় নিঃশেষ এক জীবন



১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই। এই দিনটি অভিশাপ হয়ে এসেছিল যুবক ফজলু মিয়ার জীবনে। পুলিশের সন্দেহের কারণে তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গেল ২২টি বছর। আজ বৃহস্পতিবার তাঁর মুক্তি মিলছে বটে, কিন্তু আর কি ফিরে পাবেন তিনি স্বপ্নময় সেই জীবন?http://adexcelbd.com/www/delivery/lg.php?bannerid=0&campaignid=0&zoneid=47&loc=http%3A%2F%2Fwww.kalerkantho.com%2Fprint-edition%2Ffirst-page%2F2015%2F10%2F15%2F279307&referer=https%3A%2F%2Fwww.google.com%2F&cb=9911204d5b

২২ বছর আগে সিলেটের আদালতপাড়ায় ঘোরাঘুরি করার সময় পুলিশের একজন ট্রাফিক সার্জেন্টের সন্দেহের শিকার হন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার তেতলি ইউনিয়নের ধরাধরপুর গ্রামের ফজলু মিয়া। এরপর তাঁকে সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ফজলুর বিরুদ্ধে পাগল আইনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। সেই থেকে তিনি কারাগারেই ছিলেন।

গতকাল বুধবার ফজলু মিয়াকে ভুক্তভোগী হিসেবে আদালতে উপস্থাপনের পর জামিন মঞ্জুর হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার তাঁকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

ফজলুকে আইনি সহায়তা দেওয়া বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্টের আইনজীবী জ্যোৎস্না ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'আদালতে ফজলু মিয়াকে আসামি নয় বরং একজন ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করেছি। আদালত বিষয়টি অনুধাবন করে জামিন মঞ্জুর করেছেন।'

ফজলু মিয়াকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর একসময়ের সহপাঠী দক্ষিণ সুরমার তেতলি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য কামাল উদ্দিন রাসেল। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তাঁকে (ফজলু) অনেক বছর খুঁজে ফিরেছি। কিন্তু পাইনি। তিন বছর আগে জানতে পারি তিনি মারা গেছেন। এরপর খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে দেই। কিন্তু কয়েক দিন আগে জানতে পারি, তিনি কারাবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। এরপর খোঁজখবর নিয়ে তাঁর জামিনের ব্যবস্থা করি।'

জানা গেছে, ফজলু মিয়া যখন গ্রেপ্তার হন তখন তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ২৭-২৮ বছর। এখন তাঁর বয়স ৫০ পেরিয়েছে। শরীর ভেঙে গেছে। ঠিকমতো হাঁটাচলাও করতে পারেন না। কথাও জড়িয়ে যায় মুখে। অতীতের কিছুই যেন তাঁর মনে নেই। অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন দেখাচ্ছিল তাঁকে।

ধরাধরপুর গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফজলু ওই গ্রামের সৈয়দ গোলাম মাওলার ছেলে। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর তাঁর মা-বাবা দুজনই মারা যান। পরিবারের আর কেউ নেই। তিনি বিয়ে করেননি, সংসার হয়নি তাঁর। এই ২২ বছর তাঁকে কেউ কারাগারে দেখতে আসেনি। কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিয়েছেন গুনে গুনে ১৯৭ দিন। সেই আদালতপাড়ায়ও দেখা হয়নি তাঁর কোনো স্বজনের সঙ্গে।



আদালতে নথিপত্র ঘেঁটে যতটুকু জানা গেছে তা হলো ১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই সিলেটের আদালতপাড়া থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে ফজলু মিয়াকে আটক করেন তৎকালীন ট্রাফিক সার্জেন্ট জাকির হোসেন। সন্দেহের বশে ৫৪ ধারায় ফজলুকে ধরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। তারপর ফজলুর বিরুদ্ধে পাগল আইনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ।


পরে ২০০২ সালে ফজলুকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। আদালত থেকে আদেশ পেয়ে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে মুক্তি দেন। কিন্তু মানসিক ভারসাম্যহীন এই ব্যক্তিকে নিতে কেউ আসেননি। ফলে তাঁকে আবারও নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে। এরপর কেটে গেছে আরো ১৩ বছর।

সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ছগির মিয়া বলেন, 'আদালতের নির্দেশ যাই থাক না কেন, আমরা তো গেটের বাইরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি না। সমাজসেবা কর্তৃপক্ষ তাদের সেই দায়িত্বটা পালন করতে পারেনি।'

একসময় ফজলুর এই বিভীষিকাময় জীবনের কথা গণমাধ্যমে উঠে আসে। ফলাও করে প্রচার হয় ফজলু মিয়ার করুণ কাহিনী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। কিন্তু তার পরও আইনের মারপ্যাঁচে কেটে যায় আরো ১০ বছর।

অবশেষে গতকাল আদালতে হাজির হন ফজলু মিয়া। এটি ছিল তাঁর ১৯৮তম হাজিরা। সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম জহুরুল হক চৌধুরী তাঁর জামিন আবেদন শোনেন। ফজলু মিয়ার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন জ্যোৎস্না ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সৈয়দ শামিম আহমদ। পরে আদালত কামাল উদ্দিন রাসেলের জিম্মায় ফজলুকে জামিন দেন।

কামাল উদ্দিন রাসেল বলেন, ফজলুকে চিকিৎসা করানো দরকার। আজ মুক্তি পেলে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর অন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটা ঠিক করা হবে।

কামাল আরো জানান, এর মধ্যে ঢাকার দুটি প্রবীণ নিবাস ফজলুর দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাঁরা ভেবে দেখছেন কী করা যায়।


- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/10/15/279307#sthash.qMUu4vV8.dpuf
Share on Google Plus

About Advocate REAGAN

    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment