মুসলিম আইনে ত্যাজ্যপুত্র ও দত্তক


রা শে দু জ্জা মা ন ম জু ম দা র
লেখক : আইনজীবী
rashed_law121@yahoo.com
বাংলাদেশে উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো মূলত মুসলমান ও হিন্দুদের নিজস্ব ধর্মীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মুসলিম আইনে দত্তক বা ত্যাজ্যপুত্র কোনোটির মাধ্যমেই উত্তরাধিকার সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না। অপরদিকে হিন্দু আইনে দত্তক পুত্রের আইনগত উত্তরাধিকার জন্মায় এবং ত্যাজ্যপুত্র ধারণাটা কিছুটা শর্তসাপেক্ষে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। 

মুসলিম আইনে দত্তক গ্রহণ করার বিধান নেই। মুসলিম আইনের বিধান বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য। মুসলিম আইনে রক্তের সম্পর্কিত এবং বিয়ের মাধ্যমেই উত্তরাধিকার সৃষ্টি হয়, তাছাড়া অন্য কোনোভাবে অর্জিত অধিকার স্বীকার করে না। দত্তকের মাধ্যমে অন্যের সন্তান সম্পত্তিতে অধিকার পাবে, আর এতে প্রকৃত অংশীদাররা বঞ্চিত হবে। ইসলাম কোরআনের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তিতে বঞ্চিত করাকে হারাম করেছে।
একজন বাইরের লোককে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করলে পারিবারিক পর্দা রক্ষা হয় না যা হারাম। দত্তক পুত্র দত্তক গ্রহীতার স্ত্রীর ছেলে হবে না, তার কন্যার ভাই হবে না। দত্তক যদি সম্পত্তির অধিকার দাবি করে তবে যারা প্রকৃত উত্তরাধিকারী তাদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেবে যা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করবে।

তবে দত্তক নেয়া অপরাধ বা গোনাহ নয়, সেক্ষেত্রে দত্তক ভিন্ন অর্থে হবে। দত্তকের ভিন্নার্থ ইসলামে নিষিদ্ধ নয়, যদি কোনো এতিম বা গৃহহীন অথবা পরিত্যক্ত শিশুকে তার মঙ্গলের জন্য নিজের পুত্রের মতো অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় ইত্যাদি দিয়ে পালন করা হয়। নিঃসন্তান দম্পতি কোনো শিশুকে স্নেহ দিয়ে লালন-পালন করে তাকে যা কিছু ইচ্ছা দান করতে পারে, তবে তার মৃত্যুর পর ওই দত্তক কোনো সম্পত্তি পাবে না। মূলত মুসলিম আইনে এভাবে পালিত পুত্রের কোনো আইনগত অধিকার নেই। মুসলিম আইনে জন্মসূত্রে সন্তান সম্পত্তির অধিকারী, তা অন্যভাবে খর্ব করা যায় না।
রাসুলুল্লাহও (সা.) একটি শিশুকে তাঁর গৃহে আশ্রয় দিয়ে লালন-পালন করেছেন। হজরত জায়েদ (রা.) নামের ওই পালিত পুত্র যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। রক্ত সম্পর্কিত না হওয়ায় পালিত পুত্র নিজের পুত্র হিসেবে স্বীকৃত নয়। পালিত পুত্র বা কাউকে নিজের পুত্রের মতো আদর ভালোবাসা দেয়া ইসলামে খুবই পুণ্যরে কাজ। 

বাংলাদেশে ১৯৫৬ সালের হিন্দু দত্তক ও ভরণ-পোষণ আইনে দত্তক নেয়ার বিধান আছে, তবে দত্তক নেয়া যায় শুধু পুত্র সন্তানের। দত্তক সন্তানও পিতার সম্পত্তিতে অধিকার পাবে। হিন্দু ধর্মে পুত্রসন্তানের গুরুত্ব অনেক, কারণ পুত্র না থাকলে স্বর্গেও স্থান নেই। কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে একজন পুত্রহীন একজন নাবালক ছেলেকে দত্তক নিতে পারে। পিণ্ডদানের মাধ্যমে পুত্র পিতার মৃত্যুর পর পাপমোচন করে, তাই হিন্দু ধর্মে পুত্রসন্তান দত্তক নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। তবে সংশোধিত ভারতীয় দত্তক ও ভরণ-পোষণ আইনে কন্যাশিশুকেও দত্তক নেয়া যায়। দত্তক গ্রহণকারী আইন অনুযায়ী চুক্তি করার যোগ্য হতে হবে। একজন পুরুষই হিন্দু ধর্মের সমগোত্রীয় একজনকে দত্তক নিতে পারে। তবে বিধবা স্ত্রীলোক স্বামীর পূর্বানুমতি নিয়ে দত্তক নিতে পারে। ভারতীয় দত্তক আইনে অনেকগুলো সংশোধনী আনা হয়েছে, যার মধ্যে কন্যাশিশুর দত্তক এবং মহিলাদের দত্তক নেয়াও বৈধ করা হয়েছে। 

ত্যাজ্যপুত্র দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত একটি সামাজিক ধারণা, যা মূলত আইনে অনুপস্থিত। সাধারণত মা-বাবার অবাধ্য সন্তানদের প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, সন্তান মা-বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চললে বা বখে গেলে কোনোভাবেই যখন সঠিক পথে আনা যায় না তখন মা-বাবা ত্যাজ্যপুত্র করার ভয় দেখান, যা আমাদের সমাজে পারিবারিক আনুগত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ফলপ্রসূ। কারণ প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ত্যাজ্যপুত্র সম্পত্তিতে তার অধিকার হারায়। ত্যাজ্যপুত্র সাধারণত মৌখিকভাবে করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে পিতা হলফনামা করে তার সম্পত্তিতে ওই সন্তানের সম্পত্তির অধিকার বাতিল করার ঘোষণা দেন। অনেক ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে ত্যাজ্য করেন অথবা এই মর্মে ঘোষণা দেন যে তার সন্তান যদি তার বাধ্যমত হয়, তবেই ওই ঘোষণা বাতিল করা হবে। বস্তুুত সন্তানের বেপরোয়া আচরণে মা-বাবা অতিষ্ঠ হয়েই এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।

সাধারণত বিত্তশালী পরিবারে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। ত্যাজ্যপুত্র একটি ভ্রান্ত ধারণা, যা বাংলাদেশের কোনো আইনে বিধৃত নেই । প্রকৃত মুসলিম আইন না জানার কারণে এমন অমূলক একটি বিষয় সমাজে প্রচলিত এবং নানা রকম সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। 
বাংলাদেশে ১৯৬৫ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ও ১৮৯০ সালের ভরণ-পোষণ আইন প্রচলিত। এতে বলা হয়েছে, সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার এমনকি যদি পিতা-মাতার বিয়েবিচ্ছেদ ঘটেও। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৬ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত। পিতা অসচ্ছল হলে এবং মা সচ্ছল হলে সেক্ষেত্রে মাকে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। এভাবে পিতামহ এমনকি চাচা পর্যন্ত কোনো সন্তানের ভরণ-পোষণ দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত।

মুসলিম আইনে সন্তানের উত্তরাধিকার জন্মসূত্রেই সুস্পষ্ট, যা কোনোভাবেই খর্ব করা যায় না। তবে বাবা চাইলে সে তার সম্পত্তি জীবিতাবস্থায় দান করে যেতে পারে অন্য কাউকে, অথবা উইল করে সম্পত্তি দান করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি দান করতে পারে। দান বা হেবার ক্ষেত্রে বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। উইল বা অছিয়ত রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়, যে কোনো সময় বাতিল করতে পারেন এবং ১৮৭২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনে বিক্রি করতে পারেন। 

পিতা-মাতার কাছে তার সন্তান প্রাধান্য পাবে এটাই স্বাভাবিক এবং মুসলিম আইনেও তাদের উত্তরাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে নরহত্যাজনিত অপরাধে অর্থাত্ কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করলে সে ব্যক্তি সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে এবং যদি সে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে তাতেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে । 

ত্যাজ্যপুত্র ধারণাটি বাংলাদেশে মুসলমানদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় বাবার মৃত্যুর পর অন্য উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তি বণ্টনের সময় অংশ দেয় না বা দিতে অনিচ্ছুক হয়। অপরদিকে প্রকৃত আইনের অজ্ঞতার কারণে সালিশকারীদের পক্ষপাতমূলক বা ভুল সিদ্ধান্ত দিতে দেখা যায়। এতে মুসলিম আইনের লঙ্ঘন ঘটে, আর তাই ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এক্ষেত্রে ১৮৯৩ সালের বাটোয়ারা আইনে ৫০০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে দেওয়ানি আদালতে বাটোয়ারা মামলা করা যায়। 

হিন্দু আইনে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ধর্মান্তরিত হওয়া, দুশ্চরিত্র হলে, শারীরিক বা মানসিকভাবে অসমর্থ হলে, হত্যাকারী হলে, সন্ন্যাসী হলে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তবে ১৮৫০ সালের ঈধংঃব উরংধনরষরঃরবং জবসড়াধষ অপঃ পাস হওয়ার পর ভারতে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। অপরদিকে মুসলিম আইনের বিধানে শুধু নরহত্যার ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

সূত্র: http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/08/04/157643#.VjrOuJP0o4k


Share on Google Plus

About Advocate REAGAN

    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment